বাঁচার জন্য বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা প্রয়োজন
By Super Adminবিধান চন্দ্র দাস
৬ জুন, ২০২১ ০০:০
চলতি দশক (২০২১-২০৩০) জাতিসংঘের বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার দশক। জাতিসংঘ এটি ঘোষণা করেছিল ২০১৯ সালে। এই ঘোষণার উদ্দেশ্য ছিল, বিশ্বব্যাপী বাস্তুতন্ত্রের জন্য ক্ষতি প্রতিরোধ করা ও অবনমিত বাস্তুতন্ত্রকে তার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনাসহ এ সম্পর্কে দেশে দেশে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা। সংগত কারণেই জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি এ বছর (২০২১) বিশ্ব পরিবেশ দিবসের (৫ জুন) প্রতিপাদ্য করেছে ‘বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার’ (ইকোসিস্টেম রেস্টোরেশন)। আসলে পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হলে বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধারের কোনো বিকল্প নেই।
বাস্তুতন্ত্র শব্দটি এসেছে ‘ইকোসিস্টেম’ শব্দ থেকে। ১৯৩৫ সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী স্যার আর্থার জর্জ ট্যানসিল সর্বপ্রথম ‘ইকোসিস্টেম’ শব্দটি তাঁর একটি লেখায় ব্যবহার করেন। বাস্তুতন্ত্র বলতে খুব সহজভাবে কোনো একটি জায়গার জীবদের মধ্যকার সম্পর্ক ও তাদের সঙ্গে সেখানকার জড়ের সম্পর্ককে বোঝানো হয়। যেমন—সুন্দরবনের যত উদ্ভিদ, প্রাণী ও অণুজীব আছে তাদের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক ও এসব জীবের সঙ্গে সুন্দরবনের মাটি, পানি, আলো, বায়ু ইত্যাদি জড়পদার্থের সম্পর্ককে আমরা সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্র বলতে পারি। ট্যানসিল এই সমুদয় জটিল সম্পর্কগুলো বাস্তুতন্ত্রের (ইকোলজি) একক হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে এর ব্যাপ্তি অতি ক্ষুদ্র একটি জায়গা থেকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড পর্যন্ত হতে পারে বলে উল্লেখ করেছিলেন।
বাস্তুতন্ত্র যে সেবাগুলো আমাদের প্রদান করে, তাকে দ্রব্যগত সেবা (খাদ্যশস্য, কাঠ, জৈব জ্বালানি, ওষুধ ইত্যাদি), নিয়ামক সেবা (জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ, পরাগায়ণ, পানি পরিষ্কারকরণ, বর্জ্য পরিশোধন, জীবতাত্ত্বিক নিয়ন্ত্রণ, মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা ইত্যাদি), সহায়ক সেবা (পুষ্টিচক্র, সালোকসংশ্লেষণ, মাটি গঠন ইত্যাদি) ও সাংস্কৃতিক সেবা (গাছপালাযুক্ত প্রাকৃতিক দৃশ্য, বিভাময়যুক্ত প্রাণীদের দর্শন, জলচর জীব দর্শন ইত্যাদি)—এই চার ভাগে ভাগ করা হয়। বাস্তুতন্ত্রের এই সেবাগুলো ছাড়া আমরা আমাদের বেঁচে থাকার কথা চিন্তাই করতে পারি না।
কোনো বাস্তুতন্ত্রে জীব ও জড় উপাদানগুলোর নির্দিষ্ট অনুপাত বিনষ্ট হলে সেখানে তৈরি হয় বিশৃঙ্খলা। বাস্তুতন্ত্র হয় ক্ষতিগ্রস্ত। ফলে সেখানকার বাস্তুতান্ত্রিক সেবা আর আমরা পাই না। আমাদের চারপাশের বাস্তুতন্ত্র যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে আমাদের পক্ষে বেঁচে থাকা আর সম্ভব হবে না। কিন্তু সেই ঘটনাটি ঘটতে চলেছে বলে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। গোটা পৃথিবীতেই স্থলজ ও জলজ দুই ধরনের বাস্তুতন্ত্রেরই অবনমন ঘটেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গার বন, তৃণভূমি, মিঠা পানি, সমুদ্র, উপকূল, পর্বত ইত্যাদি বাস্তুতন্ত্রগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে বিভিন্ন গবেষণাপত্রে উঠে এসেছে।
স্থলজ বাস্তুতন্ত্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বন বাস্তুতন্ত্র। কার্বন শোষণ থেকে শুরু করে উল্লেখযোগ্য বাস্তুতান্ত্রিক সেবাগুলো পাওয়া যায় বন বাস্তুতন্ত্র থেকে। কিন্তু পৃথিবীব্যাপী বন বাস্তুতন্ত্র হুমকির মুখে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিগত ২০১৫ থেকে ২০২০-এর মধ্যে প্রতিবছর পৃথিবীতে প্রায় এক কোটি হেক্টর বন ধ্বংস হয়েছে। বন বাস্তুতন্ত্রের এই ধ্বংসের জন্য প্রধানত কৃষি, গাছ কাটা, জ্বালানি সংগ্রহ, দূষণ, মাটি ক্ষয়, দাবানল ও পরক প্রজাতির আক্রমণকে দায়ী করা হয়েছে।
স্থলজ বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে সর্ববৃহৎ হচ্ছে তৃণভূমির বাস্তুতন্ত্র। ভূপৃষ্ঠের ৪০ শতাংশই হচ্ছে তৃণভূমি। বন বাস্তুতন্ত্রের আলোচনার তুলনায় তৃণভূমির বাস্তুতন্ত্র নিয়ে আলোচনা কম হয়। অথচ তৃণভূমির বাস্তুতান্ত্রিক সেবাও কম মূল্যবান নয়। গত বছর (২০২০) ‘নেচার’-এ প্রকাশিত এক প্রবন্ধে বলা হয়েছে, তৃণভূমি বায়ুমণ্ডল থেকে যথেষ্ট পরিমাণ কার্বন শোষণ করে তা মজুদ রাখাসহ বাস্তুতান্ত্রিক অনেক সেবা প্রদান করে থাকে। বনভূমির মতো তৃণভূমির বাস্তুতন্ত্রেরও অবনমন ঘটেছে। পৃথিবীতে বিগত চার দশকে ৪০ শতাংশ তৃণভূমির অবনমন ঘটেছে। জলাশয় পার্শ্ববর্তী পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ তৃণভূমিতে কৃষিকাজ, অত্যধিক পশুচারণ, মাটির গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যাওয়া, আগুন, পরক প্রজাতির আক্রমণ ইত্যাদি কারণে সাধারণত তৃণভূমির বাস্তুতন্ত্র নষ্ট হচ্ছে।
জলজ বাস্তুতন্ত্র বিশেষ করে মিঠা পানির বাস্তুতন্ত্র, জলাভূমির বাস্তুতন্ত্র ও সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র থেকে প্রাপ্ত সেবাগুলোও আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য। নানা ধরনের দূষণ (রাসায়নিক, প্লাস্টিক), বাঁধ ও স্থাপনা নির্মাণ, পানির অত্যধিক ব্যবহার, বালি ও নুড়ি উত্তোলন ইত্যাদি কারণে মিঠা পানির আধারগুলো গভীর সংকটে পড়েছে। জলাভূমির বাস্তুতন্ত্রেরও অবনমন ঘটে চলেছে। সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের জন্য প্লাস্টিক এখন অন্যতম হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। পৃথিবীর প্রায় ৮০ শতাংশ বর্জ্য মিশ্রিত পানি সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে। নির্বিচারে মৎস্য আহরণও জলজ বাস্তুতন্ত্রে সংকট সৃষ্টি করেছে।
বাস্তুতন্ত্রগুলো পুনরুদ্ধারের জন্য বাস্তুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ওপর বর্ণিত কারণগুলো যতদূর সম্ভব নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রকৃতিনির্ভর সমাধানগুলো যেমন—পুনর্বনসৃজন, কৃষি ও সামাজিক বনায়ন, পুনরুৎপাদী কৃষি, উপকূলকে বাফার জোন হিসেবে সংরক্ষণ, জলাশয় সংরক্ষণ, সৌরশক্তি ও বৃষ্টির পানি ব্যবহার, প্লাস্টিক নিয়ন্ত্রণ ও তার বিকল্প ব্যবহার, বর্জ্য পরিশোধন, কৃষিতে জৈব সার ও জৈব বালাইনাশক ব্যবহার ইত্যাদির বাস্তবায়নসহ সবুজ ও নীল অবকাঠামো কৌশল গ্রহণে জোর দিতে হবে।
বাংলাদেশে বন, পাহাড়, মিঠা পানি ও উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্রে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাতসহ জনসংখ্যার অভিঘাত তৈরি হয়েছে। বিগত কয়েক দশকে বাংলাদেশে বনের অবক্ষয় ঘটেছে। সুন্দরবনে ‘অধিক নোনা’ (পলিহ্যালাইন) অঞ্চলের আয়তন বেড়ে যাওয়ার ফলে সেখানকার বাস্তুতন্ত্রের অবনমন হয়েছে। বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায়ও অত্যধিক লবণাক্ততা দেখা দিয়েছে। পাহাড়ি এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে ভবন নির্মাণ ও কৃষির জন্য সেখানকার প্রাকৃতিক বন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একটি গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়েছে যে বাংলাদেশের পাহাড়ি এলাকায় বছরে প্রতি হেক্টর জমিতে ১০ থেকে ১২০ টন মাটি ক্ষয় হচ্ছে। সময়ের ব্যবধানে বাংলাদেশ থেকে বহু নদী হারিয়ে গেছে। যেগুলো অবশিষ্ট আছে, সেগুলোর বেশির ভাগ রুগ্ণ ও মৃতপ্রায়। পলি জমে নদীর গভীরতা কমে গেছে। দখলে সংকীর্ণও হয়েছে বহু নদী। প্লাস্টিক, ময়লা-আবর্জনা থেকে শুরু করে বিষাক্ত সব পদার্থে নদীগুলো এখন ভীষণভাবে দূষিত। দেশের হাওর, বাঁওড়, বিলগুলোও ভালো নেই। কৃষি, রাস্তাঘাট, অবকাঠামো, দূষণ, পশুচারণ ইত্যাদি কারণে এগুলোর অবনমন ঘটেছে।
দেশে অবনমিত বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধারে সমন্বিত কৌশল অবলম্বন করা প্রয়োজন। সামাজিক ও কৃষি বনায়ন আরো ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণ করলে, বন বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধারে তা সহায়ক হতে পারে। সুন্দরবন এলাকার নদীগুলোতে মিঠা পানির প্রবাহ বৃদ্ধির জন্য বর্ষা মৌসুমের পানিকে মজুদ ও তা কাজে লাগানোর কৌশল বের করতে হবে। দেশের নদীগুলো সংস্কার ও দখলমুক্ত করতে পারলে সেগুলোতে স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরে আসবে। হাওর, বাঁওড়, বিলগুলোর ব্যবস্থাপনায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় প্রয়োজন। দেশে জলাশয়, ভূমি কিংবা বায়ুদূষণ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। মানুষের মধ্যে বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণ বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য যুগোপযোগী কর্মসূচি (ডকুড্রামা, সামাজিক যোগাযোগ, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, পুরস্কার ইত্যাদি) হাতে নেওয়া যেতে পারে। সেই সঙ্গে দেশের বাস্তুতন্ত্রগুলো পুনরুদ্ধার ও সুস্থায়ী করার কৌশল উদ্ভাবন তথা জ্ঞান সৃষ্টির জন্য নিবিড়ভাবে গবেষণা কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা প্রয়োজন।
লেখক : অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়