info@naturenlife.org

+880721-773934

বন ও বনবিজ্ঞান
বন ও বনবিজ্ঞান

বন ও বনবিজ্ঞান (Forest and Forestry)  পর্যাপ্ত জীবাশ্ম তথ্য পাওয়া না গেলেও বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা যায় যে, টারশিয়ারি যুগে (Tertiary period: ২.৬-৬.৬ কোটি বছর) বাংলাদেশের অংশবিশেষে বিস্তৃত গ্রীষ্মমন্ডলীয় অরণ্য ছিল। নিকটবর্তী অঞ্চলে মায়োসিন স্তরে প্রাপ্ত Glutaxylon, Dipetrocarpoxylon, Cynometroxylon জীবাশ্মসমূহের সঙ্গে গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে বর্তমানে বিদ্যমান প্রজাতিগুলির সুস্পষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে। বাংলাদেশের নিকটবর্তী এলাকা থেকেও গুপ্তবীজ উদ্ভিদের বেশ কিছু জীবাশ্ম আবিষ্কৃত হয়েছে। টারশিয়ারি যুগের পর আসে হিমযুগ (Glacialion period), আর সেটা চলেছে প্লিসটোসিন যুগেও (Pleistocene period), যার শুরু এখন থেকে প্রায় ১০ লক্ষ বছর আগে আর শেষ ২৫,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। এই পর্যায়ে মাঝে মাঝে উদ্ভব হয় আন্তঃহিমযুগের (Interglacial period) যখন জলবায়ুর শৈত্য হ্রাস পায়। তাপমাত্রা হ্রাস পাওয়ায় অধিকাংশ স্তন্যপায়ী অবলুপ্ত হয় এবং টারশিয়ারি ও সিওয়ালিক (Siwalik) যুগের উদ্ভিদকুলের ব্যাপক ক্ষতি হয়।

প্রাচীনকালে মানুষ প্রচুর কাঠ ব্যবহার করত। বাংলাদেশের বনসম্পদ সম্পর্কিত সে সময়ের কোন তথ্য পাওয়া যায় না। প্রায় ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দ্রাবিড় সভ্যতার বিকাশ সম্পর্কে প্রমাণ পাওয়া যায়। এই সভ্যতার বিকাশে অরণ্য একটি বিরাট ভূমিকা পালন করে। গোড়ার দিকে আর্যরা পশুপালন করত এবং পরে কৃষিতে আগ্রহী হয়। তারা বসতি নির্মাণের জন্য নির্দিষ্ট এলাকার বন পরিষ্কার করত এবং অরণ্য ঘেরা পরিবেশে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলত।  বেদ, ব্রাহ্মণ, অরণ্যক ও পুরাণসমূহ এই উপমহাদেশের তৎকালীন বন ও বনায়ন সম্পর্কে কিছু কিছু আলোকপাত করে। বনের অবস্থান ও গঠন সম্পর্কে তথ্যাদি পাওয়া যায় বৈদিক উত্তর যুগের দুটি সাহিত্যকর্ম,  রামায়ণ ও  মহাভারত থেকে। এগুলিতে বাংলাদেশেরও সাধারণ বনবৃক্ষ শালগাছ (Shorea robusta), ধাওয়া (Anogeissus latifolia), বেল (Aegle marmelos), কিংশুক (Butea monosperma) প্রভৃতির উল্লেখ রয়েছে। মহাকাব্যে আরও উল্লেখ রয়েছে যে, গঙ্গা নদীর তীরে গভীর বন ছিল, কিন্তু সে বর্ণনা থেকে বনের সঠিক অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া কঠিন।

Forest.jpg

পরবর্তী বিবেচ্য যুগ হলো গ্রিকদের আগমন ও মৌর্যশাসন আমল। মেগাস্থিনিস তৎকালের বর্ণনায় লিখেছেন: ‘ফল ও বৃক্ষশোভিত অনেকগুলি সুউচ্চ পর্বত এবং অনেকটা সুদৃশ্য অত্যন্ত উর্বর বিশাল সমতল ভূমি, যা অসংখ্য নদ-নদী দ্বারা বিচ্ছিন্ন।’ সম্রাট আশোক বন ও বন্যপ্রাণী খুব ভালবাসতেন এবং তিনি বন সংরক্ষণের ব্যবস্থাও করেন।  হিউয়েন-সাং (Hinen Tsang) ৬২৯-৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে ভারত ভ্রমণে আসেন। তাঁর স্মৃতিকথায় তখনকার বনসমূহের অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়। তিনি শ্রাবস্তী, কপিলাবস্ত্ত ও রামগ্রামসহ নিকটবর্তী অঞ্চলে গভীর বনের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি রামগ্রাম থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হন বিখ্যাত এক অরণ্য পথে, যা ছিল অপ্রশস্ত ও অত্যন্ত বিপদসংকুল। অরণ্য থেকে বেরিয়ে তিনি কৃষ্ণগড় নামক দেশে পৌঁছান। এই বিখ্যাত পর্যটক পুন-না-ফা-তান (PUN-NA-FA-TAN) বা পুন্ড্রবর্ধন (কানিংহামের মতে পাবনা এবং ফারগুসনের মতে রংপুর) অতিক্রম করেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, পুন্ড্রবর্ধন ছিল একটি নিম্নাঞ্চলীয় দেশ। সেখানকার ভূমি ছিল আর্দ্র, উর্বর ও সমৃদ্ধ; সেখানে ছিল প্রচুর কাঁঠাল গাছ। অতঃপর হিউয়েন-সাং সমতটে অর্থাৎ বর্তমান বৃহত্তর যশোর, ঢাকা ও ফরিদপুর অঞ্চলে পৌঁছান এবং এখানকার ভূমি নিম্ন, আর্দ্র জলবায়ু এবং পর্যাপ্ত গাছপালা ও হিংস্র জীবজন্তুর কথা উল্লেখ করেন।

মুগল সম্রাটদের আমলে কৃষিকাজের জন্য বনাঞ্চল আবাদে উৎসাহ দেওয়া হতো। বাবর তাঁর দিনলিপিতে বর্ণনা দিয়েছেন যে, উড়িষ্যার ৫টিসহ সুবে-বাংলার ২৪টি সরকার ছিল। স্যার জে.এন. সরকার প্রণীত তালিকায় আকবরের সময়কার সুবে বাংলায় ১৬টি সরকার এবং ব্রিটিশ আমলের শেষভাগের বাংলায় জেলার সংখ্যা প্রায় সমান বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বর্তমান বাংলাদেশ ভূখন্ডে এসব সুবার যেগুলি অবস্থিত সেগুলি হলো জান্নাতাবাদ- মালদহের অংশ যা এখন নবাবগঞ্জ নামে পরিচিত; ফতেহাবাদ- ফরিদপুর, দক্ষিণ বাখেরগঞ্জ এবং গঙ্গা নদীর মোহনায় অবস্থিত দ্বীপাঞ্চল; মাহমুদাবাদ- উত্তর নদীয়া, উত্তর যশোর ও পশ্চিম ফরিদপুর; খিলা ফতেহাবাদ- দক্ষিণ যশোর ও পশ্চিম বাখেরগঞ্জ; বাকলা- উত্তর ও পূর্ব বাখেরগঞ্জ এবং দক্ষিণ ও পশ্চিম ঢাকা; ঘোড়াঘাট- দক্ষিণ রংপুর, দক্ষিণ-পূর্ব দিনাজপুর ও উত্তর বগুড়া, পিঞ্জিরা- দিনাজপুর এবং রংপুর ও রাজশাহীর অংশবিশেষ; বারবাকাবাদ- প্রধানত রাজশাহী, দক্ষিণ-পশ্চিম বগুড়া ও দক্ষিণ-পূর্ব মালদহ; বাজুহা- রাজশাহীর অংশ, বগুড়া পাবনা ও ঢাকার অংশবিশেষ; সোনারগাঁও- পশ্চিম ত্রিপুরা ও নোয়াখালী।

আবুল ফজল জান্নাতাবাদ, খলিফাবাদ ও বাজুহায় অবস্থিত বনের কথা উল্লেখ করেছেন। খলিফাবাদে প্রচুর বুনোহাতি এবং বাজুহায় মাস্ত্তল তৈরির জন্য লম্বা ও পুরু কাঠ পাওয়া যেত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। জান্নাতাবাদের বিস্তৃত তৃণ ভূমিতে বুনো মহিষ চরে বেড়াতো। এই বর্ণনা অনুযায়ী বর্তমান সুন্দরবন উত্তরে আরও সম্প্রসারিত হয়ে উত্তর নদীয়া ও উত্তর যশোর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এবং সেখানে পাওয়া যেত কুমির আর বাঘ।

বন সম্পর্কে মুগলরা ছিল অনেকটা উদাসীন। তারা বনকে প্রধানত সংরক্ষিত শিকার ভূমি হিসেবে ব্যবহার করত। উদ্যান ও ছায়ানিবিড় রাজপথ নির্মাণে গাছ ব্যবহূত হতো। মোটকথা, গাছ সম্পর্কে তাদের মনোভাব ছিল সৌন্দর্যবোধ প্রভাবিত, তাতে সংরক্ষণ, বিস্তার, উন্নয়নসহ বনায়নের সমস্যা সম্পর্কে কোন পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টিভঙ্গি ছিল না।

মুগল আমলের শেষে আসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং পরে ব্রিটিশ শাসন। গোড়ার দিকে, অর্থাৎ অষ্টাদশ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত জাহাজ নির্মাণ ও রেলের স্লিপার তৈরির জন্য ব্যাপক পরিসরে বন ব্যবহার শুরু হয় এবং এ সময় বন সংরক্ষণের কোন প্রচেষ্টা ছিল না। প্রথম বন রক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয় দক্ষিণ ভারতে। ভারতের তৎকালীন বড়লাট লর্ড ডালহৌসী ১৮৫৫ সালের ৩ আগস্ট এক বিবৃতি প্রকাশ করেন যাতে প্রথমবারের মতো সমগ্র ভারতবর্ষে বন সংরক্ষণের একটি রূপরেখা ছিল। স্ট্যাবিং (Stabbing) এটাকে ‘ভারতীয় বনসম্পদের সনদ’ হিসেবে অভিহিত করেন। ব্রানডিস ১৮৫৬ সালে মহাবনপরিদর্শক নিযুক্ত হন। ব্রিটিশ ভারতে সর্বপ্রথম বন বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৮৬৪ সালের ১ নভেম্বর।

ব্রানডিসের অধীনে এবং সহকারী হিসেবে ক্লেঘোরা’র (Cleghora) সহায়তায় ভারতে প্রথম বিজ্ঞানসম্মত বন ব্যবস্থাপনার সূচনা হয়। ১৮৬৫ সালে ভারতীয় বন আইন পাশ এবং ১৮৬৯ সালে ফরেস্ট সার্ভিস গঠিত হয়। বলা যায় যে, ১৮৭০ সাল নাগাদ ব্রানডিস বন বিভাগের ভিত্তি স্থাপন করেন। একটি নিয়মিত ফরেস্ট সার্ভিস চালু হয় এবং ১৮৭১-১৯০০ সালের মধ্যে বনবিদ্যা সুনির্দিষ্ট অগ্রগতি অর্জন করে। অতঃপর বনের সীমানা নির্ধারণ এবং ১৮৭৮ সালে বন আইন (Act VII, 1878) সংশোধন করা হয়। ফরেস্ট সার্ভিসের নির্বাহী ও নিয়ন্ত্রণ শাখায় নিয়োগের জন্য ১৮৭১ থেকে ১৯০০ সালের কারিগরি শিক্ষা ও কর্মী প্রশিক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। প্রথম বন বিদ্যালয় স্থাপিত হয় ১৮৭৮ সালে উত্তর ভারতের দেরাদুন শহরে। ১৯০৬ সালে লর্ড কার্জন দেরাদুনে ইম্পিরিয়াল ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট স্থাপন করেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৮) এবং ভারতীয় স্বশাসন (Home Rule) ও অসহযোগ আন্দোলন বনাঞ্চলের ওপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। এই সময় বনের ক্ষতিসাধন এবং বন আইন লঙ্ঘনের ফলে বিপুল পরিমাণ বনসম্পদ ধ্বংস হয়। ১৯১৯ সালে বিকেন্দ্রীকরণ সম্পর্কিত রাজকীয় কমিশন মহাবনপরিদর্শকের নিকট থেকে কর্ম পরিকল্পনা প্রস্ত্ততের পরামর্শ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয় এবং ১৯২১ সালে বন প্রশাসন প্রদেশের নিকট হস্তান্তরিত হয়। ১৯২৬ সালে ভারত সরকার মহাবনপরিদর্শকের পদ ও বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্টের পদ একত্রিত করে। ক্রমান্বয়ে প্রদেশগুলির প্রধান বন সংরক্ষকগণ নিজ প্রাদেশিক প্রশাসকদের নিকট দায়বদ্ধ থেকে স্বীয় অধিদপ্তরের স্বতন্ত্র প্রধান হন।

মহাবনপরিদর্শক ব্রানডিস ১৮৬২ সালে তৎকালীন বাংলার কতিপয় বন পরিদর্শন করেন। কলকাতা বোটানিক গার্ডেনের সুপারিনটেনডেন্ট এম.টি অ্যান্ডারসন ১৮৬৪ সালে আসাম ও বাংলা প্রদেশের অস্থায়ী বন সংরক্ষক পদে নিযুক্ত হওয়ার পরই এই অঞ্চলে বনসংরক্ষণের প্রথম পদক্ষেপের সূচনা হয়। ১৮৬৫ সালে বন সংরক্ষকের অফিস কলকাতায় স্থাপিত হয়। শুরুতে সিকিম, ভুটান ও আসাম এই তিন স্থানে তিনটি বন বিভাগ স্থাপনের প্রস্তাব থাকলেও মাত্র একটি অনুমোদন লাভ করে। ১৮৬৫ সালে সিনকোনা চাষের দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী বনসংরক্ষক ম্যান (Mann)-এর নেতৃত্বে সিকিম বিভাগ স্থাপিত হয়। অ্যান্ডারসন পরিচালিত প্রাথমিক জরিপের ওপর ভিত্তি করে বনাঞ্চল সংরক্ষণের ব্যবস্থা পাকা হয়। দার্জিলিং বনাঞ্চলে ১৮৬৬ সালে বন সংরক্ষণের নোটিস জারি করা হয়। ১৮৭০ সাল নাগাদ দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, কালিমপং ও বাকসারে (Buxa) সংরক্ষিত বনের জরিপ ও সীমানা নির্ধারণের কাজ সম্পূর্ণ হয়।

১৮৭৯ সালে সুন্দরবনের ৪৮৫৬ বর্গ কিলোমিটার (১৮৭৫ বর্গ মাইল) এলাকাকে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ১৮৯৩ সালে হিনিং (Heining) সুন্দরবনের কর্মপরিকল্পনা প্রস্ত্তত করেন। ১৮৮০ সালে প্রথমবারের মতো এখানে গুলিছোঁড়া, শিকার ও মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা হয়। অ্যান্ডারসন পদত্যাগ করার পর ১৮৬৭ সালে লিডস (Leeds) বন সংরক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৮৭২ সালে ড. সিলিচ (Dr Schlich) বন সংরক্ষক হিসেবে যোগদানের পর নিম্নবর্ণিত ৫টি বন বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়: ১. কুচবিহার বিভাগ কুচবিহার কমিশনারশিপের সীমানা নিয়ে গঠিত (বনপাল, বন কর্মকর্তা ছিলেন বনসংরক্ষকের অধীন); ঢাকা বিভাগ (সিলেট ও কাছার) বনপাল ছিলেন বনসংরক্ষকের অধীন; আসাম বিভাগ আসাম কমিশনারশিপের সীমানা নিয়ে গঠিত (বনপাল কমিশনারের অধীন থাকলেও পরিদর্শন ও হিসাব নিয়ন্ত্রণ ছিল বনসংরক্ষকের এখতিয়ারে); চট্টগ্রাম বিভাগ চট্টগ্রামের কমিশনারশিপের সীমানা নিয়ে গঠিত। কমিশনার ছিলেন বনসংরক্ষক। পরামর্শদান ছাড়া বাংলার বনসংরক্ষকের কোন এখতিয়ার ছিল না; ভাগলপুর বিভাগ পাটনা, ছোটনাগপুর ও ভাগলপুর নিয়ে গঠিত।

বন সম্পর্কিত প্রশিক্ষণের জন্য ১৯০৭ সালে কুর্সঙের ডাওহিলে একটি বনবিদ্যালয় স্থাপিত হয় এবং ১৯২৪ সালে একজন বন বিশেষজ্ঞ সেখানে নিয়োগ লাভ করেন। ১৯৩১ সালে বন ব্যবহার কর্মকর্তার (Forest Utilization Officer) একটি পদ সৃষ্টি করা হয়। ১৯২৫ সালে ই.ও শেবারে (EO Shebbare) বেসরকারি বনের ব্যাপারে পদ্ধতিগত অনুসন্ধান শুরু করেন। ১৯১৯-২০ সালে কক্সবাজার বিভাগ গঠিত হলেও ঢাকা-ময়মনসিংহ বিভাগ গঠিত হয় ১৯২৫-২৬ সালে। ১৯২৭ সালে বেঙ্গল ফরেস্ট সার্কেল বিভক্ত হয়ে উত্তর ও দক্ষিণ সার্কেল গঠিত হয়। একই বছর ১৮৭৮ সালের বন আইন (Act VII, 1878) সংশোধন এবং ১৯২৭ সালের বন আইন কার্যকর করা হয়। সুন্দরবন, চট্টগ্রাম পার্বত্য এলাকা, কক্সবাজার ও ঢাকা-ময়মনসিংহ নিয়ে গঠিত হয় দক্ষিণ সার্কেল, যা এখন বাংলাদেশের অংশ। সমগ্র উত্তর সার্কেলটি পড়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট বঙ্গদেশ পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ব বাংলায় (পূর্ব পাকিস্তান) বিভক্ত হয়ে যায়। দক্ষিণ সার্কেলের বন বিভাগ (চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, ঢাকা-ময়মনসিংহ ও খুলনা জেলাধীন সুন্দরবন) পূর্ব বাংলার বনাঞ্চলভুক্ত হয়। আসামের সিলেট বিভাগও পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়।

একজন বনসংরক্ষকের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানের বন প্রশাসন গঠন করা হয়। পরবর্তীকালে প্রথমে দুটি এবং পরে তিনটি বন সার্কেল পূর্ব সার্কেল, পশ্চিম সার্কেল ও উন্নয়ন সার্কেল গঠিত হয়। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেট পূর্ব সার্কেলে থেকে যায়। সুন্দরবন, ঢাকা ও ময়মনসিংহ পড়ে পশ্চিম সার্কেলে এবং কর্ম পরিকল্পনা ও ব্যবহার বিভাগ নিয়ে গঠিত হয় উন্নয়ন সার্কেল। বনপালদের (foresters) প্রশিক্ষণের জন্য সিলেটে একটি বন বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়।

১৯৬০ সালে প্রধান বনসংরক্ষকের পদ সৃষ্টি করা হয়, এবং ফরেস্ট রেঞ্জারদের প্রশিক্ষণের জন্য চট্টগ্রামে একটি কলেজ স্থাপন করা হয়। বন গবেষণা ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রীয় সরকারের বিষয় হিসেবেই রয়ে যায় এবং তা মহাবনপরিদর্শক কর্তৃক রাওয়ালপিন্ডি (পশ্চিম পাকিস্তান) থেকে নিয়ন্ত্রিত হতো। পাকিস্তান সরকার বন গবেষণা ইনস্টিটিউটকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের নিকট হস্তান্তর করে এবং এটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটে রূপান্তরের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ জোগায়।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সৃষ্টির পর উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিবর্তন দেশে একটি নতুন বননীতির সূচনা করে। ১৯৭২ সালে এই নীতি গ্রহণকল্পে নতুন প্রচেষ্টা শুরু হয়। ‘সকলের জন্য বন’ এই শ্লোগানকে ধারণা করে সংরক্ষিত বনের বাইরে বৃক্ষসম্পদ বৃদ্ধির ওপর অধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয় এবং পতিত ও প্রান্তিক জমিতে এবং গ্রামের বনেবাদাড়ে বৃক্ষরোপণ জোরদার করা হয়। জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্যও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

১৯৮০ সাল থেকে বাংলাদেশের বনের প্রশাসনিক কাঠামোতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে। সামাজিক বনায়নে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং যেসব জেলায় বন নেই অথবা কম রয়েছে সেসব জেলা সামাজিক বনায়নের আওতায় আনা হয়। রংপুর, বগুড়া, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর ও পাবনায় নতুন বন বিভাগ এবং বগুড়া ও যশোহরে দুটি নতুন সার্কেল প্রতিষ্ঠা করা হয়। একইভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে বৃক্ষহীন অশ্রেণীকৃত সরকারি বনে গাছ লাগানোর জন্য খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, কাপ্তাই ও রাঙ্গামাটিতে বন বিভাগ গড়ে তোলা হয়েছে। সদর দপ্তরে বন প্রশাসনের কর্মতৎপরতাও বৃদ্ধি পায় এবং প্রধান বনসংরক্ষককে সহায়তা প্রদানের জন্য ৩টি উপপ্রধান বনসংরক্ষকের পদ সৃষ্টি করা হয়। বর্তমানে ৭টি সার্কেল ও ৩১টি বিভাগ রয়েছে। সার্কেলগুলির প্রত্যেকটিতে একজন বনরক্ষক এবং বিভাগগুলিতে উপ-বনরক্ষক মর্যাদার একজন কর্মকর্তা নেতৃত্ব দেন। এছাড়াও জাতীয় বোটানিক্যাল গার্ডেন, কাপ্তাইয়ের বন উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং চট্টগ্রামস্থ বন মহাবিদ্যালয়ে সার্বক্ষণিক বনসংরক্ষক নিয়োগ করা হয়েছে।  [সৈয়দ সালামত আলী]

বনভূমির প্রকারভেদ' (Forest type)  বাস্ত্তসংস্থানিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশের বনভূমি নিম্নোক্ত শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে: ক্রান্তীয় আর্দ্র চিরসবুজ, ক্রান্তীয় আধা-চিরসবুজ, ক্রান্তীয় আর্দ্র পত্রমোচী, জোয়ারধৌত বন ও কৃত্রিম বন।

ক্রান্তীয় আর্দ্র চিরসবুজ বন (Troppical wet evergreen forest)  সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যসহ এখানে চিরসবুজ গাছগাছালির প্রাধান্য। এই বনে কিছুটা আধাচিরসবুজ ও পত্রমোচী বৃক্ষও থাকে, কিন্তু তাতে বনের চিরসবুজ প্রকৃতি বদলায় না। চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চল, পার্বত্য চট্টগ্রাম, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কক্সবাজার ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মৌলভীবাজার জেলায় এ ধরনের বনভূমি রয়েছে। বৃক্ষসমূহ ৪৫-৬২ মিটার পর্যন্ত হতে পারে। আর্দ্র ছায়াঢাকা স্থানে পরাশ্রয়ী অর্কিড, ফার্ন ও ফার্নজাতীয় উদ্ভিদ, লতা, মস, কচু, বেত ইত্যাদি প্রায় সর্বত্রই জন্মে। গুল্ম, বীরুৎ ও তৃণ কম, এ জাতীয় বনে প্রায় ৭০০ প্রজাতির সপুষ্পক উদ্ভিদ রয়েছে। কালিগর্জন, ধলিগর্জন, সিভিট, ধুপ, কামদেব, রক্তন, নারকেলি, তালী, চুন্দাল, ঢাকিজাম ইত্যাদি সাধারণ চিরহরিৎ বৃক্ষ প্রজাতি যেগুলি সর্বোচ্চ ছাউনি (canopy) সৃষ্টি করে। চাঁপা, বনশিমুল, চাপালিশ, মাদার ইত্যাদি আধাচিরহরিৎ ও চিরহরিৎ বৃক্ষ বিক্ষিপ্তভাবে জন্মে। পিতরাজ, চালমুগরা, ডেফল, নাগেশ্বর, কাউ, গোদা, জাম, ডুমুর, করই, ধারমারা, গামার, তেজবল মদনমাস্তা, আসার, মুস, ছাতিম, তুন, অশোক, বড়মালা, ডাকরুম, বুরা ইত্যাদি দ্বিতীয় স্তরের ছাউনি সৃষ্টি করে। মাঝে মাঝে Gnetum ও Podocarpus নামক দুটি নগ্নবীজী উদ্ভিদ দেখা যায়। এ বনে কয়েক প্রজাতির বাঁশও রয়েছে।

চিরসবুজ বন

ক্রান্তীয় আধা-চিরসবুজ বন (Tropical Semi-evergreen forest)  বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে এ বন সাধারণত চিরহরিৎ, কিন্তু পত্রমোচী (deciduous) বৃক্ষেরও প্রাধান্য রয়েছে। এ বনভূমি সিলেট, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের দিনাজপুরের পাহাড়ি এলাকা নিয়ে গঠিত। প্রধানত জুমচাষ করা হয়। এখানে আট শতাধিক প্রজাতির সপুষ্পক উদ্ভিদ রয়েছে। চিরসবুজ বন অপেক্ষা এ জাতীয় বনে গাছতলায় (undergrowth) উদ্ভিদ অধিক জন্মে। উঁচু আচ্ছাদন সৃষ্টিকারী বৃক্ষ ২৫-২৭ মিটার উঁচু। উপত্যকা ও আর্দ্র ঢালে চাপালিশ, তেলশুর, নারকেলি প্রজাতিগুলিই বেশি জন্মে। গুটগুটিয়া, তুন, পীতরাজ, নাগেশ্বর, উড়িআম, নালিজাম, গোদাজাম, পীতজাম, ঢাকিজাম ইত্যাদি মধ্যমাঞ্চলে ছাউনি সৃষ্টি করে। ডেফল ও কেচুয়ান নিম্নস্তরের আচ্ছাদক। অপেক্ষাকৃত অধিক উষ্ণ ও শুষ্ক ঢালে এবং খাঁজে বিভিন্ন প্রজাতির গর্জন, বনশিমুল, শিমুল, শিলকরই, চুন্দুল, গুজা বাটনা, কামদেব, বুরা গামারি, বহেড়া ও মুস উপরের ছাউনি সৃষ্টি করে। গাব, উদাল ও শিভাদি মধ্যম উচ্চতার ছাউনি সৃষ্টি করে, এবং আদালিয়া, বড়মালা, গোদা, অশোক, জলপাই ও দারুম নিচু ছাউনি সৃষ্টি করে। সাধারণ চিরসবুজ উদ্ভিদ প্রজাতিগুলি হলো গর্জন, শিমুল, বনশিমুল, বাটনা, চাপালিশ, তুন, করই ও জলপাই। এ বনভূমির উদ্ভিদের উত্তরাংশের সঙ্গে পূর্ব-হিমালয় ও দক্ষিণাংশের সঙ্গে আরাকানের উদ্ভিদের সাদৃশ্য রয়েছে। এই বনগুলির মোট আয়তন প্রায় ৬,৪০,০০০ হেক্টর যা বাণিজ্যিক কাঠের ৪০% যোগায়। পূর্বে প্রবর্তিত সেগুনের সঙ্গে সাম্প্রতিক রাবার চাষের ফলে এ বনভূমির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে।

গাজীপুর,শালবন

ক্রান্তীয় আর্দ্র-পত্রমোচী বন (Tropical moist deciduous forest)  শাল (Shorea robusta) গাছের প্রাধান্য বিধায় সাধারণত শালবন নামে পরিচিত। বর্তমানে ঢাকা, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর ও কুমিল্লা অঞ্চলে বিস্তৃত এ বনভূমির দুটি সুস্পষ্ট বলয় রয়েছে (প্রায় ১০৭,০০০ হেক্টর)। বৃহৎ অংশটি ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার মধ্যবর্তী অঞ্চলে প্রায় ৮০ কিমি দীর্ঘ ও ৭-২০ কিমি চওড়া যা মধুপুরগড় নামে পরিচিত। ক্ষুদ্রতর অংশটি শেরপুর জেলায় ভারতের গারো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত, ৬০ কিমি লম্বা ও ১.৫-১০ কিমি চওড়া। তাছাড়া রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁ ও নওগাঁ জেলায় শালবনের কিছু বিচ্ছিন্ন অঞ্চল (প্রায় ১৪,০০০ হেক্টর এলাকা জুড়ে) এবং কুমিল্লা জেলার শালবন বিহার, ময়নামতি ও রাজেশপুরে কিছু অবশেষ (২০০ হেক্টর) ছড়িয়ে রয়েছে। বিশ শতকের প্রথম দিকে কুমিল্লা থেকে ভারতের দার্জিলিং পর্যন্ত একটি অবিচ্ছিন্ন শালবন ছিল। বর্তমানে বনের অধিকাংশই দখল হয়ে গেছে। অবিশষ্ট বনের গাছের মজুদ ও গুণমান নিম্নস্তরের। বর্তমানে শালবন এলাকায় রয়েছে অসংখ্য ধানক্ষেত। বনের অবিচ্ছিন্ন ছাউনি ১০-২০ মিটার উঁচু, অধিকাংশই পত্রমোচী প্রজাতি। শাল (প্রায় ৯০%) ছাড়া অন্যান্য সাধারণ বৃক্ষের মধ্যে রয়েছে পলাশ, হালদু, জারুল বা সিধা (Lagerstroemia parviflora), বাজনা, হাড়গজা, আজুলি (Dillenia pentagyna), ভেলা, করই, মেনদা (Litsea monopetala), কুসুম, উদাল, ডেফাজাম, বহেড়া, কুরচি, হরীতকী, পিতরাজ, শেওড়া, সোনালু, আসার, আমলকি ও অধগাছ (Croton oblongifolius)। লতার (অধিকাংশই কাষ্ঠলতা) মধ্যে রয়েছে কাঞ্চনলতা, আনিগোটা (Zizyphus rugusa), কুমারীলতা, গজপিপুল, পানিলতা, নানা জাতের মেটে-আলু (Dioscorea species), শতমূলী ও গিলা। গাছতলার প্রজাতির সংখ্যাও যথেষ্ট (৫০ গণের প্রায় ২৫০টি প্রজাতি) যাদের মধ্যে আসামলতা, ভাঁট, বৈঁচি, ময়নাকাঁটা, আসাল ইত্যাদিরই প্রাধান্য। ঘাসের মধ্যে ছনই বেশি। কিছু পরাশ্রয়ী উদ্ভিদও রয়েছে। শিম, সিজ ও কলমী গোত্রীয় উদ্ভিদও রয়েছে।

জোয়ারধৌত বন (Tidal forest)  খুলনা, পটুয়াখালী, নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের এই উপকূলীয় বনগুলি (একত্রে প্রায় ৫২০,০০০ হেক্টর) বাংলাদেশের সর্বাধিক উৎপাদনশীল বনভূমি। প্রতিবার জোয়ারের সময় এ বনভূমি সমুদ্রের পানিতে প্লাবিত হয়। এখানকার চিরসবুজ গাছগুলির আছে বায়ুমূল এবং বংশবিস্তার জরায়ুজ ধরনের। সুন্দরি ছাড়াও পশুর, গেওয়া, কেওড়া, কাঁকড়া, বাইন, ধুন্দুল, আমুর ও ডাকুর দলবদ্ধভাবে জন্মে। উপকূলীয় পানির ঘোলাটে ভাব ও লবণাক্ততা সেখানকার প্রজাতিগুলির বিন্যাস ও বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণ করে। সুন্দরবন ছাড়াও গাঙ্গেয় বদ্বীপের অনেকগুলি চরই ম্যানগ্রোভের গভীর বনে ঢাকা, নেই শুধু সুন্দরি। নদীর পলি জমে ওঠা তীর ও ফাটলেই এসব প্রজাতি দ্রুত বেড়ে ওঠে। নদী ও খালের পাড়ে ঠেসমূলীয় (rhizophoreceous) প্রজাতির প্রাধান্য দেখা যায়।

জোয়ারধৌত বন

কিছু বন কিছু নির্দিষ্ট বাস্ত্তসংস্থানে সীমিত থাকে। এসব বনের মধ্যে রয়েছে ১. বেলাভূমি বা তটীয় বন- চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বরিশাল ও পটুয়াখালী অঞ্চলের সমুদ্র উপকূল বরাবর বিস্তৃত। এখানে নানা ধরনের ও ঘনত্বের ঝোপঝাড়ের সঙ্গে জন্মে ঝাউ, কেরুং, পনিয়াল, কাঠবাদাম, মাদার, পিপুল ও নিশিন্দা; ২. স্বাদুপানির নিম্নভূমির বন- সিলেট, সুনামগঞ্জের হাওর ও পার্বত্য বনাঞ্চলের নিচু এলাকায় অবস্থিত। এসব এলাকা বর্ষায় প্লাবিত হয় ও মাটি অত্যন্ত পানিসিক্ত থাকে। সিলেট অঞ্চলে নিম্নভূমির বনে প্রচুর তৃণজাতীয় উদ্ভিদ- ইকড়, খাগড়া ও নল জন্মে। হাওরগুলির পাড়ে প্রায়শই শুধু হিজল বন দেখা যায়। এখানকার গাছতলার গাছগাছড়া হলো প্রধানত বেত, গুঁয়েবাবলা (Lantana species) এবং বড় জাতের ঘাস ও বেনা। বৃক্ষের মধ্যে রয়েছে- কড়ই, শিমুল, কালউঝা (Cordia dichotoma), ভাটকুর (Vitex heterophylla) ও জারুল। গাছতলার প্রজাতি হলো তেরা (Alpinia), কেউমূল (Costus), মুর্তা ও দাঁতরাঙ্গা/লুটকি (Melastoma) ও নল। এসব বিশেষ ধরনের বন ছাড়াও পাহাড়ি ছোট নদী বা ছড়ার কিনারে স্বকীয় গাছগাছালিসহ আরও স্থানীয় কিছু বন রয়েছে যেখানে গাছের মধ্যে জন্মে চালতা, পিটালি, কাঞ্জল (Bischofia javanica), জারুল, অশোক, ভুবি (Baccaurea ramiflora), জলপাই, শেওড়া ও ডুমুর এবং এইসঙ্গে অনেক প্রজাতির পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ, ফার্ন ও মস।

পার্বত্য বন আবাদের পর নতুন বনায়ন এলাকায় প্রথমে জন্মে গোলসাগু (Cariota urens), বুরা (Macaranga species), বড়মালা (Callicarpa arborea), কাশিপালা (Hibiscus macrophyllus), গোদা (Vitex peduncularis), জীবন (Trema orientalis), নুনকচি (Glochidion species), আমলকি, কুরচি, এলেনা (Antidesma), কদম, ডেফাজাম (Cleistocalyx operculata), কড়ই, উদাল, বাজনা, কাঁটা কশই, তুন, ভাদি, গুটগুটিয়া (Proteium serratum), বাটা, হাড়গোজা ও বিভিন্ন প্রজাতির ঘাস। প্রাকৃতিক বনভূমির ক্রমাগত হ্রাসের কারণেও কিছু বিশেষ ধরনের বন সৃষ্টি হয়, যাকে তৃণজাতীয় অগোছালো জঙ্গল বলা যায় (প্রায় ৭৫০,০০০ হেক্টর)। বর্তমানে ছন চাষের জন্য এসব গৌণ জঙ্গল প্রায়ই পোড়ানো হয়।

আবাদি বন (Plantation forest)  প্রতিবছর রোপিত এই বন দুভাগে বিভাজ্য: ১. রোপিত রাষ্ট্রীয় বন- ১৮৭১ সালে বর্তমান মায়ানমার থেকে বীজ এনে পার্বত্য চট্টগ্রামের কাপ্তাইয়ে সেগুন চাষের প্রাথমিক উদ্যোগ নেওয়া হয়। তখন থেকেই আবাদি বন গাছ কেটে নতুন করে বনায়নের অংশ হয়ে উঠে। ১৯২০ সাল পর্যন্ত এটি শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামেই সীমাবদ্ধ ছিল। তারপর চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগেও সম্প্রসারিত হয়। বছরে বনায়নের হার ছিল ৪০০ হেক্টর। সেগুনের পর লাগানো অন্যান্য প্রজাতি হলো গামারি, চাপালিশ, গর্জন, মেহগনি, জারুল, তুন, পাইন ও জাম। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ব্যাপক বনায়ন কর্মসূচি গৃহীত হয়। ১৯৭৪ সালে বন বিভাগ জ্বালানি কাঠ উৎপাদনের জন্য গামারি, Albizia falcata; কদম, Acacia species; Eucalyptus species ও পাইনের মতো দ্রুতবর্ধনশীল বৃক্ষ ব্যাপকভাবে রোপণ শুরু করে; ২. ব্যক্তিমালিকানাধীন আবাদি বন- চিরাচরিত প্রথা হিসেবেই বসতবাড়িতে সাফল্যের সঙ্গে বিভিন্ন বৃক্ষ ও ফসল জন্মানো হয়। এ জাতীয় বন রাষ্ট্রীয় বনভূমি ধ্বংসের বিপরীতে দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বসতবাড়ির বনভূমিতে প্রায় ১৬০ প্রজাতির বৃক্ষ পাওয়া যায়। এই ধরনের বন সরকারি বনের তুলনায় ১৫-২৫ গুণ বেশি উৎপাদনশীল। [মোস্তফা কামাল পাশা]

তথ্যসূত্র ঃ বাংলাপিডিয়া