মাটিদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন

বিধান চন্দ্র দাস

ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০

পৃথিবীর জলবায়ুসহ পরিবেশের প্রায় সব কয়টি উপাদান আজ বিপন্ন। বায়ু, পানি ও মাটি থেকে শুরু করে পৃথিবীর জীব সম্প্রদায় কমবেশি সংকটাপন্ন। কিন্তু এসব সংকটাপন্ন উপাদানের মধ্যে মাটির কথা তেমনভাবে আলোচিত হয় না। সন্দেহ নেই, বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমানে মানুষের অস্তিত্ব টিকে থাকার ব্যাপারে হুমকি সৃষ্টি করেছে। নির্মল বায়ু ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দিন দিন গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। জীববৈচিত্র্যও আজ বিপদাপন্ন। আর তাই সংগত কারণেই এগুলো নিয়ে মানুষ চিন্তিত। কিন্তু পরিবেশের আর একটি অন্যতম উপাদান মাটিও যে সমস্যাক্লিষ্ট, তা নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হতে দেখা যায় না। অথচ বহুদিন আগে থেকেই বিজ্ঞানীরা কিন্তু মাটি ক্রমাগতভাবে বিষাক্ত, লবণাক্ত, ক্ষারীয়সহ নানা ধরনের অবক্ষয়জনিত সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার কথা বলে আসছেন। সত্যি কথা বলতে কি, মাটির এই অনুর্বর ও বিষাক্ত হওয়ার ধারা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে তা কিন্তু মানবসভ্যতার বিপর্যয় ডেকে আনবে। কারণ আমাদের ৯৫ শতাংশ খাদ্য পাওয়া যায় মাটি থেকেই।

এরই মধ্যে জাতিসংঘ মাটিদূষণকে ‘গুপ্ত বিপদ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বিশেষ করে জাতিসংঘের কয়েকটি সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত আইপিবিইএস (ইন্টার গভর্নমেন্টাল সায়েন্স-পলিসি প্ল্যাটফর্ম অন বায়োডাইভার্সিটি অ্যান্ড ইকোসিস্টেম সার্ভিসেস) মাটির অবক্ষয় বিষয়ে যে বৈশ্বিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তা রীতিমতো আশঙ্কাজনক। জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুতান্ত্রিক সেবাগুলোর আন্ত সরকার বিজ্ঞাননীতি মঞ্চ ‘আইপিবিইএস’– জাতিসংঘের অন্যতম শক্তিশালী একটি সংস্থা। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি), ইউনেসকো, বিশ্বখাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) ও ইউএনডিপি এই সংস্থার পৃষ্ঠপোষক। ২০১২ সালের এপ্রিলে প্রতিষ্ঠিত আইপিবিইএসের বর্তমান সদস্য সংখ্যা বাংলাদেশসহ ১৩০টি দেশ। সংস্থাটির প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি দ্বারা পরিচালিত হয়। এই সংস্থার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সরকার, বেসরকারি সংস্থা ও সুধীসমাজের কাজে জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুতান্ত্রিক সেবাকেন্দ্রিক মূল্যায়ন বিজ্ঞানসম্মত ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে তুলে ধরা। যার ফলে স্থানীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এসব বিষয়ে কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হয়।

চলতি বছরের এপ্রিলে কলম্বিয়ার মেডিজিন-এ অনুষ্ঠিত আইপিবিইএসের ষষ্ঠ সভায় বৈশ্বিক মৃত্তিকা অবক্ষয় ও পুনরুদ্ধারবিষয়ক কমিটির মূল্যায়ন প্রতিবেদন অনুমোদিত হয়। মোট ৯৬৫ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদন তৈরি করতে ৮৬ জন বিশিষ্ট বিজ্ঞানীসহ প্রায় ২০০ মানুষ তিন বছর ধরে কাজ করেছিল। প্রতিবেদনে চমকে ওঠার মতো পরিসংখ্যান হচ্ছে এই যে পৃথিবীতে বছরে প্রায় সোয়া কোটি হেক্টর জমির অবক্ষয় হচ্ছে। আর এর ফলে পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক মানুষ (৩২০ কোটি) নানা জায়গায় মাটি অবক্ষয়জনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মাটিদূষণের কারণে বছরে প্রায় ১০ থেকে ১৭ শতাংশ বাস্তুতান্ত্রিক সেবাজনিত জিজিপি (গ্লোবাল গ্রস প্রডাক্ট) নষ্ট হচ্ছে। মুদ্রামানে এই ক্ষতির সর্বোচ্চ পরিমাণ বছরে ১০.৬ লাখ কোটি ইউএস ডলার বলে জানা গেছে। প্রতিবেদনের উপসংহারে মাটি অবক্ষয় রোধে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

আইপিবিইএস প্রতিষ্ঠার বহু আগে ১৯২৪ সালে আন্তর্জাতিক মৃত্তিকাবিজ্ঞান সমিতি (ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব সয়েল সায়েন্স) গঠিত হয়। বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রায় ৫৫ হাজার বিজ্ঞানী এই সমিতির সঙ্গে যুক্ত। প্রতি চার বছর পর পর তাঁদের আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয়। এই সমিতির উদ্যোগে ২০০২ সালে প্রতিবছর ৫ ডিসেম্বর বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়। বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক মৃত্তিকাবিজ্ঞান সমিতির এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে এবং জাতিসংঘের ৬৮তম অধিবেশনে ৫ ডিসেম্বর বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাব পাস হয়। ফলে প্রতিবছর ৫ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিকভাবে মৃত্তিকা দিবস পালন করা শুরু হয়।

বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস ২০১৮ সালের ইংরেজি প্রতিপাদ্যের ভাবানুবাদ করলে দাঁড়ায়, ‘মৃত্তিকাদূষণের সমাধান হোক’। মাটিদূষণ বন্ধ করতে পৃথিবীব্যাপী সচেতনতা তৈরির জন্যই এই প্রতিপাদ্য। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা থেকে বলা হয়েছে, আমাদের পায়ের নিচে লুকিয়ে আছে বিপদ। অদৃশ্য এই বিপদে আক্রান্ত হওয়ার আশুঙ্কা প্রায় প্রত্যেকের। আগামী ২০৫০ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা ৯০০ কোটিতে পৌঁছবে। ব্যবস্থা না নিলে মাটির অবক্ষয় হবে ভয়াবহ। খাদ্য, পানি ও বাতাসকে করে তুলবে ভয়ানক রকম বিষাক্ত। এখনো পর্যন্ত মাটিদূষণ সম্পর্কিত সবকিছু আমাদের জানা না হলেও যেটুকু জানা গেছে তা রীতিমতো আশঙ্কাজনক।

আন্তর্জাতিক মৃত্তিকাবিজ্ঞান সমিতি, বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক আণবিকশক্তি এজেন্সির সম্মিলিত ‘ভিয়েনা মৃত্তিকা ঘোষণা ২০১৫’-তে আমাদের  বেঁচে থাকার জন্য মাটি যে কত প্রয়োজনীয় তা নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, মাটি হচ্ছে—(১) পরিবেশের অন্যতম উপাদান, (২) প্রাণী, উদ্ভিদ ও অণুজীবের মূল ভিত্তি, (৩) জীববৈচিত্র্য, অ্যান্টিবায়োটিক ও জিনের আধার, (৪) পানি বিশোধনকারী ও জমাকারী, (৫) উদ্ভিদ পুষ্টির জোগানদাতা, (৬) খাদ্য তৈরির মূল ভিত্তি, (৭) কাঠ, আঁশ ও শক্তি উৎপাদনকারী শস্যের জন্য প্রয়োজনীয়, (৮) কার্বন গ্রহণকারী ও জলবায়ু পরিবর্তজনিত অবস্থা উপশমে সাহায্যকারী, (৯) মানব প্রজন্মের নিরিখে অনবায়নযোগ্য ও সসীম সম্পদ।

বিশ্বের অনেক জায়গার মতো বাংলাদেশেও মাটি ভালো নেই। কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত ২০১৭-১৮ বার্ষিক প্রতিবেদনে বিষয়টি উঠে এসেছে। বেশির ভাগ উপজেলার পরীক্ষিত মাটিতে জৈব পদার্থ ও নাইট্রোজেনের ঘাটতি পাওয়া গেছে। অম্লত্বের হারও বেশি বলে সরকারি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ফসফরাস, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, সালফার, বোরন প্রভৃতি রাসায়নিক পদার্থ সঠিক মাত্রায় নেই। উপকূলীয় এলাকায় বিশেষ করে বৃহত্তর খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের মাটিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ ধরনের মাটিতে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় ফসল ফলানো অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ, কষ্টসাধ্য ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা প্রায় অসম্ভব।

দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের মাটিদূষণের ওপর কিছু গবেষণা প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়েছে। এসব প্রবন্ধে শিল্পাঞ্চল, ইটভাটাসংলগ্ন জমি ও শহরতলির মাটিতে আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম, ভ্যানাডিয়াম, সিসা, ক্রোমিয়াম, নিকেল ও তামার ক্ষতিকর মাত্রার উপস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে। গাজীপুর শিল্প এলাকা সন্নিহিত কৃষিজমি থেকে নেওয়া ৯ ধরনের সবজি (পেঁপে, বেগুন, লাউ, ফুলকপি, মুলা, পুঁইশাক, পাটশাক, কলমিশাক, হেলেঞ্চা), দুই ধরনের ফল (কলা, পেয়ারা) ও সেখানকার মাটির নমুনা জাপানের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব রেডিওলজিক্যাল সায়েন্সেসের গবেষণাগারে পরীক্ষা করার পর সেসব নমুনায় ক্ষতিকর মাত্রায় রাসায়নিক পাওয়া গেছে। বিশেষ করে কোনো কোনো সবজির নমুনায় ক্যান্সার সৃষ্টি করার মতো রাসায়নিকের উপস্থিতিও ধরা পড়েছে। দেশের দক্ষিণে পটুয়াখালীর পায়রা নদীসংলগ্ন জমিতে লাগানো বিভিন্ন প্রকার সবজিতেও ক্ষতিকর মাত্রার রাসায়নিক পাওয়া গেছে। 

‘ভিয়েনা মৃত্তিকা ঘোষণা ২০১৫’-তে মৃত্তিকা রক্ষায় আমাদের করণীয় সম্পর্কেও কিছু দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। সেগুলো বিবেচনা করা প্রয়োজন। আমাদের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে মাটির সম্পর্ক নির্ণয়মূলক গবেষণা, বিশেষ করে ভূদৃশ্যের (ল্যান্ডস্কেপ) ওপর আমাদের কর্মকাণ্ডের অভিঘাত—মৃত্তিকাবিজ্ঞানের অন্যান্য সংশ্লিষ্ট শাখাসহ সামাজিক, আইন ও সংস্কৃতির সঙ্গে সংগতি রেখে নির্ধারণ করায় জোর দেওয়া দরকার। খাদ্য ও পানি নিরাপত্তার সঙ্গে মাটি নিরাপত্তাকেও সংযুক্ত করা আবশ্যক। কার্বন আধার হিসেবে মাটিকে জলবায়ু পরিবর্তন উপশমে মুখ্য সাহায্যকারীর ভূমিকা বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। যতটা সম্ভব নগরায়ণকে সীমিত করা এবং মাটি যাতে অবরুদ্ধ না হয় সে ব্যাপারে সজাগ থাকার সময় এসেছে। মাটি ক্ষয়, সন্নিবদ্ধকরণ (কম্প্যাকশন), পুষ্টিহীনতা, লবণাক্ততা, দূষণ ও জীববৈচিত্র্য নষ্ট হয়—এমন সব কর্মকাণ্ড থেকে যতটা সম্ভব আমাদের বিরত থাকা উচিত। মাটির গঠনপ্রণালি, ব্যবহার, রক্ষা পদ্ধতি তথা টেকসই মাটি ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরি করাও প্রয়োজন।

লেখক : নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

Tags:

No responses yet

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Latest Comments

No comments to show.