প্লাস্টিক দূষণ ও জলবায়ুর পরিবর্তন ড. কানন পুরকায়স্থ

জলবায়ুর অবস্থা নির্ভর করে বায়ুমণ্ডল, সাগর, ভূমি, বরফ, পৃথিবীর জৈব বৈচিত্র্য এবং আমাদের সৌরমণ্ডলের কেন্দ্রে অবস্থিত সূর্যের গতি-প্রকৃতির ওপর। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল তুলনামূলকভাবে অনেকটা আপেলের খোসার মতো পুরু। এর রাসায়নিক উপাদান নাইট্রোজেন, অক্সিজেন ও স্বল্পমাত্রায় অন্যান্য গ্যাসীয় পদার্থ। এই গ্যাসীয় পদার্থে রয়েছে প্রাকৃতিক গ্রিনহাউস গ্যাস, যা আমাদের জৈব বৈচিত্র্যকে রক্ষা করার জন্য অত্যন্ত কার্যকর। কিন্তু এই গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ, বিশেষ করে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে আমরা লক্ষ করি বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পায় এবং জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটে। উদাহরণস্বরূপ বৈশ্বিকভাবে পৃথিবীর পৃষ্ঠতলের তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বেড়ে চলেছে। দেড় শ বছর আগে অর্থাৎ ভিক্টোরিয়ান যুগে বৈশ্বিক তাপমাত্রা যা ছিল তার তুলনায় বর্তমান তাপমাত্রা বেড়েছে এক ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। গাণিতিকভাবে এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির পরিমাণ কম হলেও জলবায়ুর পরিবর্তন ও স্থানীয়ভাবে আবহাওয়ার ওপর এর প্রভাব অনেক বেশি। যেমন—আমরা লক্ষ করি অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ঝড়ের তীব্রতা বৃদ্ধি, বরফ গলে যাওয়ায় সাগরের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং পৃথিবীর কোনো কোনো অঞ্চলে অতি শীতলতা। সাম্প্রতিককালে সাগরের উষ্ণতার গভীরতা পরিমাপ করে দেখা যায় যে এই উষ্ণতার গভীরতা ধীরে ধীরে বাড়ছে। এতে ধারণা করা হয় যে বৈশ্বিক স্কেলে পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বিগত ২.৬ মিলিয়ন বছরের পরিবেশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে পৃথিবীর মেরু অঞ্চলে সব সময় বরফ ছিল, তবে সূর্যের চতুর্দিকে পৃথিবীর ঘূর্ণনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পৃথিবী কখনো উষ্ণ, আবার কখনো বা শীতল অবস্থার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেছে। জলবায়ুর পরিবর্তনের সঙ্গে এই প্রাকৃতিক কারণ সম্পর্কযুক্ত হলেও বিগত অর্ধশতাব্দীর অধিক সময় ধরে লক্ষ করা যায় যে পরিসংখ্যানগতভাবে পৃথিবীর পৃষ্ঠতলের গড় উষ্ণতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এর মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে গ্রিনহাউস গ্যাস। বায়ুমণ্ডলে অধিক পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাস অর্থাৎ কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড এবং অন্যান্য শিল্পজাত গ্যাস থাকা মানে হচ্ছে সূর্য থেকে পৃথিবী যে পরিমাণ শক্তি শোষণ করে, তা পৃথিবীর পৃষ্ঠতল থেকে মহাশূন্যে আবার নিঃসরিত হতে বাধা পায়। গাছপালা ও অন্যান্য প্রাণিজাত দ্রব্যাদি থেকে উৎপন্ন হওয়া জীবাশ্ম জ্বালানি, যেমন—কয়লা, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ভূগর্ভে সঞ্চিত হয়েছিল। এদের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করার ফলে বায়ুমণ্ডলে আবার কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরিত হয়। ১৭৫০ সালের তুলনায় আমাদের বায়ুমণ্ডলে এখন কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ৪০ শতাংশ বেশি। এমনকি অ্যান্টার্কটিকার হেলি রিসার্চ স্টেশন, যা শিল্প-কারখানা থেকে অনেক দূরে অবস্থিত, সেখানেও কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ রেকর্ড করা হয়েছে ৪০০ পিপিএম অর্থাৎ এক মিলিয়ন বায়ুকণার মধ্যে রয়েছে ৪০০টি কার্বন ডাই-অক্সাইড অণু।

প্রতিবছর মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ড থেকে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হয় ৩৬ বিলিয়ন টন। তার মধ্যে ৩৩ বিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অক্সাইড জীবাশ্ম জ্বালানি ও শিল্প-কারখানা থেকে নির্গত হয়। প্রায় ১৬ বিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে পুঞ্জীভূত হয় এবং বাকি কার্বন ডাই-অক্সাইডের বিনিময়  (Exchange) ঘটে বায়ুমণ্ডল, সাগর, গাছপালা, প্রাণীর বৃদ্ধি ও ক্ষয়ের মধ্যে। বায়ুমণ্ডলে যদি কার্বন ডাই-অক্সাইড ক্রমাগত পুঞ্জীভূত হতে থাকে, তাহলে এই শতাব্দী শেষ হওয়ার আগেই আমাদের সভ্যতা ধ্বংসের মুখে পতিত হবে।

এ বছর বিশ্বপরিবেশ দিবসের বিষয়বস্তু হচ্ছে ‘প্লাস্টিক দূষণকে পরাভূত করো’। কিন্তু এই প্লাস্টিক দ্রব্যসামগ্রীর সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের সম্পর্ক কী? জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতা দুটি ভিন্ন বিষয়; কিন্তু সম্পর্কযুক্ত। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি বলতে আমরা বুঝি সামগ্রিকভাবে পৃথিবীর পৃষ্ঠতলের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে এই উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলাফল। প্লাস্টিক দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন জীবাশ্ম জ্বালানি এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণ এই জীবাশ্ম জ্বালানি। সুতরাং জীবাশ্ম জ্বালানি হচ্ছে প্লাস্টিক দ্রব্য এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সাধারণ বিভাজন। গাণিতিকভাবে বিষয়টি দেখা যেতে পারে। এক কিলোগ্রাম পলিথিন তৈরি করতে প্রয়োজন হয় দুই কিলোগ্রাম তেল ও কাঁচামাল। এখানে তেল বলতে শক্তি বোঝানো হচ্ছে। এক কিলোগ্রাম তেল পোড়ালে তা থেকে সৃষ্টি হয় তিন কিলোগ্রাম কার্বন ডাই-অক্সাইড। যদি একটি প্লাস্টিক ব্যাগের গড় ওজন ৩৩ গ্রাম হয়, তাহলে পাঁচটি প্লাস্টিক ব্যাগ থেকে বায়ুমণ্ডলে আনুমানিক এক কিলোগ্রাম কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়। এখানে উল্লেখ্য, এক হিসাবে দেখা যায় বৈশ্বিক উৎপাদিত তেলের ৮ শতাংশ প্লাস্টিক তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

যুক্তরাজ্যের গ্রিন পিস প্রতিষ্ঠানের এক হিসাবে দেখা যায়, কোকা-কোলা কম্পানি প্রতিবছর ১২০ মিলিয়ন প্লাস্টিক বোতল তৈরি করে। গড় হিসাবে প্রতিবছর ২৮০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক উৎপাদিত হয়। তন্মধ্যে ২০১৬ সালে ইউরোপে ২৭ মিলিয়ন টন ও যুক্তরাষ্ট্রে ৩৩.৩ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হয়। সুতরাং এ থেকে সহজেই অনুমেয় যে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি তথা জলবায়ু পরিবর্তনে প্লাস্টিকের বিরূপ ভূমিকা অপরিসীম।

প্লাস্টিকের আরেকটি পরিবেশগত সমস্যা হচ্ছে সাগরদূষণ এবং এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া। প্রতিবছর অন্তত ১২.৭ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক সাগরে প্রবেশ করে। ২০১৫ সালের Proceedings of the National Academy of Science-এ প্রকাশিত অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানীদের গবেষণাপত্র থেকে জানা যায়, শঙ্খচিলসহ সামুদ্রিক পাখির ৯০ শতাংশের পাকস্থলীতে প্লাস্টিক রয়েছে। সমুদ্রে যে প্লাস্টিক পাওয়া গেছে তার ৮০ শতাংশই ভূমি থেকে সমুদ্রে প্রবেশ করেছে। ‘সায়েন্স’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক তথ্য থেকে জানা যায় যে প্রতিবছর যে পরিমাণ প্লাস্টিক ভূমি থেকে সাগরে প্রবেশ করে, তাতে বাংলাদেশ দশম স্থানে রয়েছে। তবে জনসংখ্যার হিসাবে বাংলাদেশের স্থান ১৮৭তম স্থানে এবং তুলনামূলকভাবে জনসংখ্যার হিসাবে ডেনমার্কের স্থান ১৯তম স্থানে রয়েছে। এলেন ম্যাক আর্থার ফাউন্ডেশন ২০১৭ সালে এক হিসাব কষে জানিয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে আমরা দেখব, সাগরে মাছের চেয়ে প্লাস্টিকের পরিমাণ বেশি। এখানে উল্লেখ্য, ২০০২ সালে বাংলাদেশই প্রথম দেশ, যে প্লাস্টিক ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। লক্ষ করা হয় যে প্লাস্টিক ব্যাগ বন্যার সময় পানি নিষ্কাশনব্যবস্থায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এরপর পৃথিবীর অনেক দেশ প্লাস্টিক ব্যাগ নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। উদাহরণস্বরূপ, মরক্কো ২০১৬ সালে ও কেনিয়া ২০১৭ সালে প্লাস্টিক ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে।

জলবায়ু পরিবর্তনে প্লাস্টিক দূষণের বিরূপ প্রতিক্রিয়াকে রোধ করতে আমরা কী করতে পারি? আমরা একদিকে মুক্তবাজার অর্থনীতির কলাকৌশল প্রয়োগ করতে পারি এবং অন্যদিকে নতুন প্রযুক্তির প্রয়োগ। মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রবক্তারা যুক্তি দেখান যে দূষণ কমাতে হলে এর জন্য বাজার সৃষ্টি করতে হবে। এই পন্থার একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। যুক্তরাজ্যে বেশ কয়েক বছর ধরে সুপারমার্কেটগুলো বিক্রীত জিনিসের সঙ্গে বিনা মূল্যে প্লাস্টিক ব্যাগ দেওয়া বন্ধ করে দেয়। বরং তারা অতি স্বল্পমূল্যে অর্থাৎ পাঁচ পেন্স বা ১০ পেন্সে বারবার ব্যবহারযোগ্য ব্যাগ বিক্রি করা শুরু করে। গ্রিন পিসের স্বেচ্ছাসেবক দল এক জরিপ করে দেখেছে যে উল্লিখিত পন্থা অবলম্বনের ফলে সমুদ্রসৈকতে প্লাস্টিক ব্যাগের বর্জ্য ৪০ শতাংশ কমে গেছে।

আরেকটি উদাহরণ হতে পারে, কার্বন ঋণাত্মক প্লাস্টিক তৈরি করা। টিম ফ্লেনারি তাঁর ‘Atmosphere of hope’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ক্যালিফোর্নিয়ার নিউ লাইট টেকনোলজি বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড আহরণ করে তৈরি করেছে ‘এয়ার কার্বন’, যা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে প্লাস্টিক। এ ক্ষেত্রে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার না করে প্লাস্টিক তৈরি করা হয়েছে।

নতুন প্রযুক্তির মধ্যে রয়েছে গ্রাফিন ও জৈব প্লাস্টিক। গ্রাফিন এক নতুন ধরনের কার্বনঘটিত পদার্থ, যা প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে ব্যবহারের সম্ভাবনা উজ্জ্বল। গ্রাফিন তৈরিতে জীবাশ্ম জ্বালানির প্রয়োজন নেই। অন্যদিকে জৈব প্লাস্টিক প্রাকৃতিকভাবে তৈরি পদার্থ।

ভলতেয়ার বলেছেন, Men argue, Nature acts। প্রকৃতি আমাদের অপেক্ষায় থাকবে না। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের যে সাম্প্রতিক চিত্র আমরা দেখি তাতে মানুষের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে পরিবেশকে দূষিত করার সুযোগ আর নেই। কারণ এই বিশ্বের জলবায়ু গ্রিনহাউস গ্যাস বৃদ্ধির প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল। প্লাস্টিক দ্রব্যসামগ্রী থেকে তৈরি দূষণ বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণকে বৃদ্ধি করে চলেছে। তা ছাড়া প্লাস্টিক দূষণ জনস্বাস্থ্যের জন্যও হুমকিস্বরূপ। তাই আমাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা হোক প্লাস্টিকের বিকল্প অন্বেষণ।

লেখক : যুক্তরাজ্যে কর্মরত পরিবেশবিষয়ক উপদেষ্টা এবং ইনস্টিটিউশন অব এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের একজন ফেলো

Tags:

No responses yet

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Latest Comments

No comments to show.